তিন বিষয়ে আলোচনা, কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি

সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিনের আলোচনা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে
ছবি: পিআইডি

রাষ্ট্রপতি ও সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন)—এই তিন বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য হয়নি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আগামী রোববার আরও আলোচনা হবে।

এই তিন বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে বিএনপির মতভিন্নতা আছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কাছাকাছি।

গতকাল ছিল দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার চতুর্থ দিন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে আলোচনা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মতো মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আলোচনাটি বিটিভি নিউজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

গতকালের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল আগের অসমাপ্ত আলোচনা শেষ করা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও রাষ্ট্রের মূলনীতি। এর মধ্যে আগের অসমাপ্ত আলোচনা শুরু হলেও শেষ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রশ্নেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আর তৃতীয় আলোচ্যসূচি ‘রাষ্ট্রের মূলনীতি’ নিয়ে আলোচনাই শুরু করা যায়নি।

গতকাল সকালে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মুলতবি আলোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে দুই ঘণ্টার বেশি আলোচনার পর প্রশ্ন আসে, সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হচ্ছে কি না, হলে উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি কী হবে, আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন। তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা মুলতবি রেখে দ্বিকক্ষ সংসদ গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষ ১০০ আসনের করার বিষয়ে একধরনের ঐকমত্য হলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অবশ্য এর আগে গত মঙ্গলবারের আলোচনায়ও একই ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি

বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এখন ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও ভোট দেবেন।

গতকালের আলোচনায় এই প্রস্তাব নিয়ে নানা ধরনের মত এসেছে। সংসদের দুই কক্ষের সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির পক্ষে কেউ কেউ মত দেন। তবে অনেকে বলেছেন, এভাবে ভোট হলে ভোটার কেনাবেচা, ভোটারদের আটকে রাখার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া সরাসরি ভোটে, শুধু সংসদের দুই কক্ষের সদস্যদের ভোটে, সংসদ সদস্যের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার প্রস্তাব আসে আলোচনায়।

তবে এখন যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়, বিএনপি সেভাবে নির্বাচনের পক্ষে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আলোচনায় বলেন, দেশে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি প্রচলিত। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার বা ফেডারেল সরকার বাংলাদেশে নেই, এ রকম হলে সেখানে ইলেকটোরাল পদ্ধতিতে ভোট হয়। সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, গোপন ব্যালটে ভোটের প্রয়োজন নেই। কারণ, ৭০ অনুচ্ছেদে যেভাবে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তাতে সংসদ সদস্যরা এ ক্ষেত্রেও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। তবে এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত জানাবেন।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, অন্তত দুই–তৃতীয়াংশ দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে। অন্ততপক্ষে সংসদের উভয় কক্ষের সসদস্যরা গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন, এটাতে কমবেশি এক জায়গায় আসা যাচ্ছে।

তখন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, গোপন ভোটের বিষয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু প্রক্রিয়া তো আগের মতোই রয়ে যাচ্ছে। গোপন ব্যালট হলেও দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে দলীয় প্রার্থীকেই সংসদ সদস্যরা সমর্থন করবেন। সে ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রার্থীই রাষ্ট্রপতি হবেন। এখানে আগের মতোই ত্রুটি থেকে যাবে।

এরপর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে ঐক্য হয়ে থাকলে তা আগে ঘোষণা করা জরুরি। কারণ, উচ্চকক্ষ না হলে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে যাওয়া যাবে না। কোনো দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সেটা ছাড়া সিদ্ধান্তে আসে যাবে না বলে তিনি মত দেন।

এরপর রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা মুলতবি রেখে আবার সংসদের উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

উচ্চকক্ষ ও প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গ

সংবিধান সংস্কার কমিশন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ নিম্নকক্ষের নির্বাচনে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। তবে এই প্রস্তাব নিয়েও দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে।

বিএনপি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে না। তারা সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে। আলোচনায় বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধান সংশোধন বিল পাস হতে সংসদের উভয় কক্ষে দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হলে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করা কি সম্ভব হবে? একটি সাধারণ বিলও (আইনের খসড়া) সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করা যাবে? কারণ, এ জন্য কোনো দলকে নির্বাচনে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হবে। অতীতে কেউ কি এত ভোট পেয়েছে?

বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন। দল দুটির প্রতিনিধিরা বলেন, তাঁরা সংসদের উভয় কক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করার পক্ষে। অন্যদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা উচ্চকক্ষে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টনের পক্ষে। তবে সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে প্রার্থী তালিকা উন্মুক্ত করতে হবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিএনপি এই প্রস্তাবের বিপক্ষে। তবে অনেক দল এই প্রস্তাবের পক্ষে। পরপর দুবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন প্রস্তাবও আছে কোনো কোনো দলের। গতকাল কিছু সময় এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গতকালের আলোচনা শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কীভাবে হবে, তা চূড়ান্ত না হলেও বর্তমান বিধান পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল স্মরণ করিয়ে দেয় এর সঙ্গে পার্লামেন্টের দ্বিকক্ষ জড়িত। এ জন্য দ্বিকক্ষ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও মো. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।

OSZAR »